সুন্দরবন ভ্রমন : ব্যক্তিগত সুখস্মৃতি ও একজন গাইডের পাঁচালী।
Article and Photos by Kabir Uddin Ahmed
নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে টার্গেট করে চারমাস আগ থেকেই খোঁজখবর করছিলাম
কিভাব সুন্দরবন যাব, কাদের সাথে যাব এসব। ToB Helpline এর সুবাদে মংলার
স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সাথে কথা হলো, এনশিওর করলেন আমাদের ট্যুরের সব আয়োজন
করে দিবেন বলে। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের দিনকয়েক আগে জানালেন কেবল আমাদের
বার জনের জন্য ব্যবহার উপযোগী তার লঞ্চটি আদারওয়াইজ ভাড়া হয়ে গেছে। অনুরোধ
করলেন আমাদের ডেট পেছাতে। সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দিলাম তাকে। কিন্তু সংগত
কারনেই মন খারাপ হলো।
হাড়বারিয়া পয়েন্ট |
ToB Helpline এর সাহায্য নিয়ে আবার
খোঁজাখুঁজি। ঢাকাস্থ এক ট্যুর অপারেটর এর সাথে কথা হলো। এনশিওর করলেন
তিনিও। শর্ত এবং চাহিদা মোতাবেক ৫০% অর্থ অগ্রিম পে করে দেই। কিন্তু জার্নি
শুরুর তিন/চারদিন আগে অনুরোধ করলেন অবশিষ্ট অর্থও পে করে দিতে, ভালো
লাগেনি যেটা। লজিক্যালও মনে হয়নি। এরপর বারজনের জাহাজ নষ্ট হয়ে গেছে জানিয়ে
অনুরোধ করলেন বড় একটি গ্রুপের সাথে বড় লঞ্চে যেতে। না করায় অগত্যা রাজি
হলেন বিকল্প ব্যবস্থা করতে। মন খারাপ হলো আবারো।
নির্ধারিত দিনে
চট্টগ্রাম থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। হানিফ পরিবহন, সৌদিয়া এবং ঈগল পরিবহন
চট্টগ্রাম- খুলনা রুটে নিয়মিত যাতায়াত করে। সচারচর এ গাড়িগুলো মংলা
পর্যন্ত যায় না বলে মংলা থেকে বত্রিশ কিমি দূরে কাটাখালী নামক পয়েন্টে নেমে
যাওয়াটাই সুবিধাজনক। তাই করি আমরা। সেখান থেকে ১,৫০০.০০ টাকায় মাইক্রোবাস
ভাড়া করে মংলা পৌছাই ঘড়ির কাটা ধরে প্লান মোতাবেক নির্ধারিত সময়ের পনর
মিনিট পর। আলহামদুলিল্লাহ্।
জনাব মোঃ কায়সুজ্জামান পিকলু, (Piqlu
Zaman) ২৮/৩০ বছরের টগবগে এক যুবক, ট্যুর অপারেটর যাকে আমাদের গাইড হিসেবে
পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আগের দিন রাতে, অপেক্ষা করে ছিলেন বাস স্টান্ডেই।
প্রাথমিকভাবে পরিচিত হলাম, কথা হলো টুকটাক। প্রথম পরিচয়েই মনে হলো অসম্ভব
আন্তরিক এবং ডেডিকেটেড। তার কাছেই জানলাম, আমাদের ট্যুর অপারেটর মাথাপিছু
টাকার একটা অংশ রেখে আমাদেরকে এই গাইড তথা অপারেটর এর কাছে হ্যান্ডওভার করে
দিয়েছেন। সবকিছু গুছিয়ে আনার দায়দায়িত্বটা তারই। অর্থাৎ একপ্রকার বিক্রি
হয়ে গেছি। অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে।
লঞ্চে উঠে পিকলু আমাদের তিন দিন
আর দুই রাতের ওভারঅল ট্যুর প্লান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা দিলেন। আমরা চলতে
শুরু করলাম পশুর নদির বুক চিড়ে। ফ্রেশ হয়ে বসলাম নাস্তার টেবিলে।
ট্যুর অপারেটর যেমনটা বলেছিলেন, ঠিক সেভাবেই ম্যানু ধরে লঞ্চে খাবার সার্ভ
করা হয়েছে সময় ধরে। সাদা ভাত, ভর্তা, ডিম, খিচুড়ি, পোলাও, রুপচাদা, রুই এর
সাথে খুলনার বিখ্যাত ফাইস্যা মাছ, গরু, দেশী মুরগি, কবুতর, বারবিকিউ,
ফ্রুটস, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিবেলায়ই খাবার ছিলো পরিমানে অত্যধিক আর
স্বাদে অতুলনীয়। দশ/ বার বছরের অভিজ্ঞ পাঁচক আংকেল হাসিমুখে সবটুকু
আন্তরিকতা দিয়েই তার কাজটি করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে।
প্লান অনুযায়ী
হাড়বাড়িয়া, কটকা, টাইগার পয়েন্ট, জামতলী সী বীচ, দুবলার চর এবং করমজল হয়ে
আমরা মংলা ফেরত আসি। লঞ্চের আকার ও সমুদ্রস্রোত বিবেচনায় নিয়ে হিরনপয়েন্ট
যাওয়া বাদ দিতে হয়েছে। শুরু থেকে শেষ, লঞ্চে ষাট ঘন্টার জার্নিতে সবটা
সময়েই আমরা আমাদের গাইডকে পেয়েছি বন্ধুর মতো, ভীষন কেয়ারিং হিসেবে। কখন কি
করতে হবে, কোন ধরনের ড্রেসআপ কমফোর্টেবল হবে, কিভাবে পথ চলতে হবে, বন্য পশু
প্রানীর দেখা পেলে কী করতে হবে সব কিছু আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন ছাত্র
পড়ানোর মতো করে। কথা প্রসংগে বলছিলেন, কেবল পেশা নয় বরং সুন্দরবন তার জন্য
একটি আবেগের জায়গাও। আমাদের এক গ্রুপমেইড সবার অগোচরে তাকে হরিনের মাংস
ম্যানেজ করা যায় কিনা বললে স্পষ্টতই না করেছেন। বলেছেন, আমাদের কারো কারো
শখের কারনে বাঘের মতো হরিনটাও বিলুপ্ত হতে শুরু করলে এ বনের অবশিষ্ট থাকবে
কী! ইস! সবার যদি এই বোধটুকু হতো! একজন পিকলুর জন্য আমাদের ট্যুরকালীন
সময়টা নি:সন্দেহে সুখকর হয়েছে অনেক। প্রথম দিকের মন খারাপ করাটা উবে গিয়ে
কেবল আনন্দঘন সময়ই কাটিয়েছি আমরা।
পৃথিবীখ্যাত সুন্দরবন, আমাদের
দেশটির জন্য সৃষ্টিকর্তার রহমতস্বরুপ এ বনের সৌন্দর্য আর বিশালতা,
বনকেন্দ্রিক নৈসর্গিক শোভা আর আমাদের মুগ্ধতা বিষ্ময় জাগানিয়া সুখস্মৃতি
কেবল এখন। খুব কাছ থেকে দেখে প্রকৃতঅর্থেই প্রেমে পড়ে গেছি এই বনের,আমাদের
গর্বের ধনের।
অপেক্ষাকৃতভাবে, বনে ঘুরার স্পটগুলোকে অনেক পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে আমার। তবুও অধিকতর সতর্কতা প্রয়োজন। এখানে সেখানে এটা
সেটা না ফেলে, বনের গাছপালার ডাল না ভেংগে, উচ্চস্বরে শব্দ করে পশুপাখিদের
স্বাভাবিক লাইফে ডিস্টার্ব না করে আমরা প্রমান দিতে পারি একজন সত্যিকারের
পর্যটনপ্রেমী হিসেবে, প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে। এটা মহানুভবতা নয়, বরং দায়
আমাদের, আমাদের দায়িত্ব।
সময় সুযোগ করে আবার কখনো যাব, ইনশাল্লাহ। সে পর্যন্ত কেবল পিকলু নয়, বরং আমার গ্রুপ মেম্বার, কলিগ ও ফ্রেন্ড Iftekharul Islam, Alamgir Hossain, Sakerin Chowdhury Shakil, Saifur Rahman Raju, Mohammad Taslim, Kazi Anowarul Hoque, Mejbah Uddin Khaled, Md Abdul Hakim, Dewan Md Billal Hossain, Sohrab Hossain Robin এবং Hasnat Mir সবাইকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা এহেন ভালোলাগার বিনির্মানে একসাথে, এক হয়ে ছিলাম বলে।
0 Response to "সুন্দরবন ভ্রমন : ব্যক্তিগত সুখস্মৃতি ও একজন গাইডের পাঁচালী।"
Post a Comment