রাঙামাটির পথের ধূলোয়

ইউটিউবে একটি গান আছে ‘কবে যাব পাহাড়ে, আহারে! আহারে! ’। গানটি যতবার শুনি মনটা উদাস হয়ে যায়। পাহাড় আমাকে বড্ড বেশী টানে। অমোঘ সেই টান। সমুদ্র আমার কাছে প্রায় অবহেলিত। পৃথিবীর মানুষকে নাকি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ ভালবাসে পাহাড় আর অন্যভাগ সমুদ্র। পাহাড়ের আছে দুর্নিবার টান। এই টান যে অনুভব করে,তার ঘরে থাকা দায়। পাহাড় চিরকালই রহস্যে ঘেরা। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অপার বিস্ময়, সৌন্দর্য এখানে ক্লান্তিহীন। পাহাড় যেন বলে,আমাকে খোঁজ, আমাকে আবিষ্কার কর, তাহলেই পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ তোমাকে দেব।

কাপ্তাই লেক

অপার্থিব সৌন্দর্যের খোঁজে মানুষ ছুটে চলে পাহাড়ে। পাহাড়ের এসে নিজেকেই খুঁজে ফিরি আমি। পাহাড়ী নদীর গতিশীলতা, বনফুল, পাহাড়ের সাথে মেঘেদের মিতালী, আঁকা-বাঁকা রাস্তা,পাহাড়ী মেয়েদের অবাধ জলকেলি-মনে জাগায় আশ্চর্য শিহরণ। শহরের দুূষিত বায়ু যখন ফুসফুসে জ্বালা ধরায়, চিন্তাশক্তি যখন শ্লথ হয়ে যায়, সুকঠিন জীবন সংগ্রামে জীবন যখন আর্তনাদ করে উঠে বলে ‘মুক্তি চাই’। ইংরেজীতে যাকে বলে ‘এস্কেপ’। তখন মনে জেগে উঠে পালাবার সাধ। শুধু আমারই না, মনে হয় সকলেরই। পালাতে চাই। পিছনে পড়ে থাকুক ঘটি-বাটি-লন্ঠন।


কাপ্তাই লেক

আজন্ম ভ্রমণপিয়াসী মন আর ক্লান্ত দেহটিকে নিয়ে চেপে বসি রাঙামাটিগামী বাসে। বাস ছাড়ে কলাবাগান থেকে। ঘড়িতে তখন রাত ১১ টা ২৫।কর্মব্যস্ত শহর তখন বিশ্রামের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। জীবনসংগ্রামে পর্যদুস্ত নগরবাসীরা নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরছে। আগামীকালের লড়াইয়ের জন্য বিশ্রাম চাই, শক্তি চাই। সারাদিন চোর,বদমাস আর প্রতারকদের ( সাধুজনেরাও আছে) সাথে সওদা করে জীবন কলুষিত,চাই প্রিয়জনের সান্নিধ্য।


গতিজড়তার জন্য কেমন যেন ঝিমুনি আসছে। মস্তিক সজাগ।বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। নিজেকে প্রশ্ন করি, কেন রাঙামাটি? অনেকবার তো গিয়েছিস ওখানে। কি আছে ওখানে? গুন গুন করে গান ধরি-
                                                   ওখ্যান গেলে মাদল পাবি,
                                                   মেয়ে-মরদের আদর পাবি,
                                                  এখ্যান তোরে মানাইছে নারে
                                                    এক্কেবারে মাইছেনারে।
                                                  নদী ধারে শিমুলের ফুল,
                                    নানা পাখির বাসা রে, নানা পাখির বাসা ।
                          কাল সকালে ফুটিবে ফুল, মনে ছিল আশা রে, মনে ছিল আশা।




অন্ধকার ভেদ করে বাস এগিয়ে চলে কুমিল্লা পিছনে ফেলে। পিছিয়ে যায়, হারিয়ে যায় শহর। ঘুম আসছে, ঘুম! কয়েক ঘন্টা পরেই মুক্তি সমাগত-সেই আনন্দই আমাকে ডেকে নিয়ে যায় ঘুমের দেশে। ভোর। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে টের পেলাম বাস চলছে রাঙামাটির দিকে। আঁকা-বাঁকা রাস্তা। জানালার বাইরে আধো আলো আধো অন্ধকার। হাল্কা কুয়াশা।বাসের সহযাত্রীরা কেউ ঘুমে, কেউ বা জেগে। বাসের প্রায় অর্ধেক যাত্রীই উপজাতীয়। আধুনিক পোষাক-আশাক। স্মাট। শিক্ষিত-শিক্ষিতা। চাকমা তরুণীগুলো বেশ সুন্দরী, তাদের কটাক্ষ যে কোন তরুণের বক্ষ চিরে দিতে পারে। ভেদভেদি পেরিয়ে বাস ঢুকে রাড়ামাটি শহরে।

কাপ্তাই লেক


হোটেল সুফিয়া ইন্টারন্যাশনাল। এর আগে যতবার রাড়ামাটি এসেছি, ততবার এই হোটেলেই উঠেছি। একসময় এই হোটেলই ছিল পর্যটকদের জন্য আর্দশ। এখন অবশ্য বেশ কিছু আধুনিক হোটেল, রির্সোট গড়ে উঠেছে। এই হোটেলের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কাপ্তাই লেকের ঠিক পাশে। এসি-নন এসি রুম। আছে নিজস্ব ঘাট। ঢাকা থেকেই ২ টি এসি রুম বুক করেছিলাম। আমার সাথে আছে আমার পরিবার,শ্যালিকা ও তার হাসবেন্ড (উদ্দেশ্য হানিমুন!)। লেক সাইড এসি রুম। বারান্দা থেকে লেকের অনেকটাই চোখে পড়ে। হোটেল প্রায় পর্যটকশূন্য। অক্টোবর মাসে সাধারণত পর্যটকরা কম আসে। বাংলাদেশে পর্যটন মৌসূম এখনও শুরু হয়নি। আমাদের মতো অল্প কয়েকজন বোর্ডার আছে। বেশীরভাগই চাটগাঁয়র।

রুম সার্ভিসের মাধ্যমে বাইরের হোটেল থেকে নাস্তা এনে খেতে হলো। হোটেলের একমাত্র রেস্টেুরেন্টটি আপাতত বন্ধ। রুম বয়ের নাম ঝুলন ! (রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে নাকি এই নামকরন)। বেশ চটপটে। তার কাছ বোট ভাড়ার খবর নিলাম। হোটেলের নিজস্ব ঘাটে আছে বোট। আপাতত ঘন্টাদুয়েক বিশ্রাম।


মায়াবী ঝর্ণা

বেলা এগারোটায় চলে এলাম ঘাটে। ঘাটে বেশ কয়েকটি কাঠের বোট আছে। একটি প্লাষ্টিক বডি বোট দেখতে পেলাম। আকারে ছোট। সুবিধা একটিই-ইঞ্চিনের শব্দ কম হয়। রেট চড়া-প্রায় ২৪০০ টাকা। ঠিক করলাম কাঠের বোট। আকারে বড়। ইঞ্চিনের শব্দ বিকট। কিছুক্ষণ মলামুলির পর ১৪০০ টাকা ঠিক হলো। মাঝি বাঙালী। সাথে কম বয়সী হেলপার। গন্তব্য শুভলং ঝর্ণা। আহামরি ঝর্ণা নয়। আগেও গিয়েছি এবং প্রতিবারই নিরাশ হয়েছি। ক্ষীণ পানির ধারা শুভলং পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ধাবিত। তাতেই পর্যটকদের কি উল্লাস! হোটেলের সীমানা ছাড়িয়ে বোট এগিয়ে চলছে শুভলং-এর দিকে। পানি নীল। দুরে সবুজ টিলার হাতছানি। পানিতে ভাসছে পানি,জুস আর সফ্ট ড্রিংকসের খালি বোতল। হায়রে মানুষ! যে পাত্রে খাস, সেই পাত্রেই হাগিস ! মৃদু বাতাস। মাথার উপর নরম রোদের ছোঁয়া। চোখের ফোকাস অসীম। চিত্ত প্রসন্ন। কর্ণ কিষ্ণিত অ¯িহর ইঞ্জিনের শব্দে। পরিবার পরিজনের সাথে হাসি-তামাসা। সেলফি। ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দ। আবেশে ঘুম চলে আসে।

আমার বড় মেয়ে রোসা ,সহধর্মী মুনিয়া, শ্যালিকা রাহা,  আর ছোট মেয়ে লিরিক

পাহাড়ের গায়ে লেথা ‘বরকল উপজেলা’, পাশেই ‘ঝুমঘর রেস্টুরেন্ট। যাইনি কখনো। বোটও থামাইনি এখানে। গন্তব্য শুভলং ঝর্ণা। দুর থেকে চোখে পড়ে শুভলং ঝর্ণা। পাহাড়ের গা ঘেসে নিচে পড়ছে পানির ক্ষীণ ধারা । খুবই হতাশাজনক দৃশ্য। বোট ভেড়ানোর ইচ্ছেটাই উড়ে গেল। পাশ কাটিয়ে চলে এলাম সামনে। পাহাড়ের উপরে সুউচ্চ বুদ্ধ মূর্তি উচ্চতা ২৯ ফুট ৮ ইঞ্চি। ছোট্ট এই দ্বীপটির নাম ‘হেমন্ত কিজিং পাড়া’। এখানে আছে বৌদ্ধ বিহার আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার আশ্রম। ধ্যানরত গৌতম-এর মূর্তি নয় এটি। এক হাত তুলে সমস্ত জগতকে আর্শীবাদ করছেন-‘জগতের সকল প্রাণী সুধী হউক’। অন্য হাতে ধরা মাটির পাত্র-অন্ন ধারক। দৃষ্টি তাঁর অসীমে। বোট ভিড়াতে বললাম। ছোট ঘাটের মতো। দু-একটি বোট ভিড়েছে। ভীড় নেই তেমন। একটি ইষ্টক নির্মিত সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে উপরে। ঘাটের পাশেই ছোট্ট বাজারের মতো। ডাব,কলা,পানীয়,কাপড়-চোপড়ের দোকান। বেচাকেনায় ব্যস্ত চাকমা নারী-পুরুষ। সূর্য মাথার উপরে। বেশ গরম। ডাবের অর্ডার দিলাম। সুমিষ্ট পানি গলা বেয়ে নেমে গেলো। ছবি তুললাম বেশকিছু। ডাবের দোকানের পাশে খানিকটা খালি জায়গা। সেথানে বসে আপনমনে বাঁশের নল দিয়ে বানানো হুকোয় দম দিচ্ছে এক আদিবাসী। আয়েশে চোখ বোঁজা। বাশেঁর চোঙায় ফিট করা কলকি দিয়ে ধূঁয়ো বের হচ্ছে। ক্যামেরার শাটারের শব্দে চোখ খুললেন তিনি। রক্ত জবার মতো টকটকে লাল। এই বাম্বু ধূমপায়ীদের কিছু ছবি তুলেছিলাম বনরূপা বাজারে। এরা যখন ধুমপাণ করে তখন তা নিবিষ্ট মনেই করে। নট নড়ন-চড়ন। ট্রাইও করেছিলাম একবার। যা কড়া! একটানেই মাথা ভোঁ-ভোঁ।


বৌদ্ধ বিহার

বোটের মাঝির সাথে আলাপ করছি নানা বিষয় নিয়ে। বেশ মিশুক। কথা প্রসংগে একটা ছড়ার (ঝর্ণা) কথা বলল। যাওয়ার পথেই নাকি পড়বে। আপত্তি করলাম না। ঘুরতেই তো এসেছি।

ছোট ঝর্ণা। নাম মায়াবী ঝর্ণা। কালচে পাথরের গা বেয়ে নেমেছে। চারিদিকে শীতল পরিবেশ। ঝর্ণা থেকে একটু দুরে ডাব নিয়ে বসেছে একজন। আক›ঠ পান করছে কয়েকজন। বেশ কয়েকজন ছেলে-ছোকরা ঝর্ণার পানিতে অবগাহন করছে মনের আনন্দে। সেকি উল্লাস! একজন গান ধরেছে, ‘ আমি তো ভালা না, ভালা লইয়াই থাইকো’। বেশ চটুল গান। ঝর্ণার পানিতে গা ধূঁয়ে ভালা হওয়ার চেষ্টায়রত। ছবি তোলা হলো, সাথে সেলফি। সেলফি এখন একজনের ছবি নয়। ফ্রেমে ঠাসাঠাসি মুখ। বাঁকানো-কেলানো হাসি।


খিদে লেগেছে। কবি সুকান্ত লিখেছিলেন,‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। আসলে পেটে খিদে থাকলে সবকিছু বিষাদ লাগে। পূর্ণিমার বিশাল চাঁদকেও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে জাগে। বোটে ফিরে এলাম। গন্তব্য ভোজনালয়। আগেই বোটের মাঝির মাধ্যমে আগেই খাবারের অর্ডার দিয়েছিলাম। টিলার উপর ছিমছাম রেস্টুরেন্ট। নাম চ্যাং-প্যাং। বোট এসে ভিড়ল রেস্টুরেন্টের ঘাটে। ইট বিছানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে। খাবারের মেনূ আগে থেকেই ঠিক করা। আতপ চালের ভাত, কাচ্চকি মাছের ফ্রাই, বাম্বু চিকেন আর ডাল। রেস্টুরেন্ট থেকে কাপ্তাই লেকের এরিয়াল ভিউ। অপূর্ব নির্সগ দৃশ্য। পাশের টিলার উপর বাঁশের কয়েকটি ঘর। চারদিকে কলা গাছের বেষ্টনী। মাথার উপর নীল আকাশ। মনে মনে ভাবি, এখানে একরাত থাকলে ভাল হতো। কিস্তু বিধি বাম। রাতে থাকার ব্যব¯হা নেই এই সব টিলায়। নির্জন নক্ষত্র ভরা রাত-ওই যে সূদুর নিহারিকা-আহ্ আফসোস! ভোজনপর্ব শেষ। বেশ তৃপ্তিকর খাবার। কাঁচকি মাছের ফ্রাই ছিল বেশ মুচমুচে।বাম্বু চিকেন আহামরি কিছু নয়। আদার গন্ধটা একটু বেশী। চা-টা যেমন তেমন।

বেলা প্রায় তিনটে। সূর্যের আঁচ তেমন একটা নেই। টুরিষ্ট বোটগুলো ফিরে চলছে। আমরাও ফিরে চলছি হোটেলপানে। একসারি জেলে নৌকা চলে গেল আমাদের বোটকে পাশ কাটিয়ে। দেখার মতো দৃশ্য।


হোটেলের বারান্দা। বাইরে বিষন্ন আলো-রাত নামছে। বারান্দা থেকে দেখছি লেকের কালো জল। মৃদু ঢেউ আছড়ে পড়ছে হোটেলের গায়ে। ঘরে ফিরছে পাখিরা। ভাবছি এখন কি করা যায়। হোটেল বয় একটা রেস্টুরেন্টের খবর দিল। পাইর্টেস রেস্টুরেন্ট। খাবারও নাকি ভালো। ঠিকানা ডিসি বাংলো পার্ক। হোটেল থেকে বের হলাম। রাত নেমেছে। মাথার উপর প্রায় গোলাকার চাঁদ। হোটেলের সামনেই ব্যস্ত রাস্তা। অটো ঠিক করা হলো। ভাড়া ১০০ টাকা। একটু বেশীই মনে হলো। আঁকা-বাঁকা মসৃন রাস্তা। চন্দ্রালোকিত রাত। কাপ্তাই লেককে হাতের বায়ে রেখে অটো ছুটে চলছে আধাঁর ভেদ করে। আধাঁরের পটভূমিতে কাপ্তাই লেকের উপর ঝুলে আছে পূর্ণিমার চাঁদ। লেকের পানিতে আলোর নৃত্য। ইচ্ছে করলে এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায় পুরো রাত। চাঁদে-ধরা মানুষ হওয়ার আপাতত ইচ্ছে নেই। ডিসি-বাংলো পার্ক। অটো নামিয়ে দিল লোহার গেটের পাশে। রাস্তা বেশ নির্জন। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম হোটেলে ফেরার অটো বা লোকাল বাস এখান থেকে পাওয়া যাবে কিনা। উত্তরে ড্রাইভার বলল, পাওয়ার স¤ভবনা কম। চিন্তার বিষয়। ড্রাইভারকে বললাম, ঠিক একঘন্টা পর এসে আমাদেরকে এখান থেকে উঠিয়ে নিতে। কিছুক্ষণ ভেবে ড্রাইভার রাজি হয়ে গেলো ভাড়া না নিয়েই।


ডিসি-বাংলো পার্কটি একটি নিচু টিলার উপরের অংশ সমতল করে বানানো হয়েছে। বিশাল সবজ মাঠ। রেলিং দিয়ে ঘেরা। গেট পেরিয়ে এগুলে হাতের বায়ে বাচ্চাদের খেলাধূলার জন্য দোলনা,স্লিপার রয়েছে। বেশকিছু কংক্রিটের বেঞ্জ। পার্কের শেষ মাথায় পুকুরের কোল ঘেষে ‘পাইর্টেস রেস্টুরেন্ট’। জলদস্যূ নৌকার আদলে তৈরী রেস্টুরেন্ট। আলোকসজ্জার জন্য অন্ধকারের পটভূমিতে চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। আসন গ্রহন করার পর মেনু দিকে চোখ বুলালাম। ফ্রাইড চিকেন, রাইস, ফ্রেঞ্জ ফ্রাই, জুস। ডিনারের অনেক সময় রয়েছে,তাই ভারী কিছুর দিকে গেলাম না। মাসরুম ফ্রাই আর ড্রিংকসের অর্ডাও দিলাম। মাসরুম ফ্রাই-এর ব্যাপারে প্রাথমিক আপত্তি উঠলো। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটুট রইলাম। ধোাঁয়া উঠা মাসরুম ফ্রাই আসলো। পেটে চালান হয়ে গেলো নিমিষেই। প্রশংসার ঝড় বয়ে গেলো আমার আর মাসরুম ফ্রাইয়ের উপর দিয়ে। মাসরুম ফ্রাই তো কম খাওয়া হয়নি,অথচ এত উপাদেয় আর মুচমুচে ফ্রাই আগে খাওয়া হয়নি। আমার ওয়াইফ ও শ্যালিকা এই ভাজা মাসরুমে এতই বিমোহিত যে, তারা পরের দিনের ডিনারের অর্ডার (সাথে এই মাসরুম ফ্রাই) অগ্রীম দিয়ে দিল। রাত গড়িয়ে নয়টা। আড্ডা আর সেলফি তুলতে তুলতে বেশ খানিকটা কোয়ালিটি টাইম পাস করলাম। অটো এসে গেছে। এবার হোটেলপানে। উদ্দেশ্য রাত্রিযাপন। রাত বেশী হয়নি, রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। বেশিরভাগ দোকানপাটের শাটার নেমে গেছে। রাতের আঁধার কেটে অটো ছুটে চলছে। কাপ্তাই লেক আর চাঁদ এখন আমাদের হাতের ডানে। রাতের সৌন্দর্য-এ আমরা প্রায় বোবা। মাথার উপর অনন্ত নক্ষত্রবীথি।

হোটেলে সকালে ঘুম থেকে উঠা আসলে একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। প্রতিবারই এই চ্যালেঞ্জে-এ হেরেছি। এরজন্য হয়তো হোটেলের নরম তুলতুলে বিছানাই দায়ী। হোটেলের পাশে এক রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা সারলাম। পরটা,ভাজি, ডিমের ওমলেট আর চা। আজ শুক্রবার। শহরে ছুটির আমেজ। আগের রাতেই ঠিক করা ছিল অটে। গন্তব্য কাপ্তাই। রেস্টুরেন্টের বাইরে অটো দাড়িয়ে। হোটেল টু কাপ্তাই আপ-ডাউন ভাড়া ১৪০০ টাকা।

যাত্রা শুরু। রোদেলা সকাল। শহরের ভিতর আঁকা-বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে অটে এগিয়ে চলছে। রাঙামাটি-কাপ্তাই রাস্তা বেশী চওড়া নয়। রাস্তার একপাশে আমাদের সংগী কাপ্তাই লেক। অন্যপাশে পাহাড়-টিলা আর জংগল। বেশ লম্বা একটি ব্রীজ কাপ্তাই লেকের উপর। ছবি তোলার জন্য নামলাম। লেকের নীল পানি। মাথার উপর পেজা তুলার মতো মেঘ। ল্যান্ডস্কেপের জন্য আর্দশ। খুব যত্ন করে ফ্রেমিং করলাম। আশানুরুপ ছবি তুলতে পেরে মনটা ভরে গেল। ড্রাইভার বলল, আরো ঘন্টা তিনেক পরে কাপ্তাই বাঁধের কাছে যাওয়া যাবে। আঁকা-বাঁকা রাস্তা ক্রমশ উপরে উঠছে। চারপাশে নৈসর্গিক দৃশ্য। রাস্তার পাশে বুনো ঝোপঝাড়ে ফুটে আছে অসংখ্য বনফুল। যতই উপরে উঠছি, ততই চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে সৌন্দর্যের অদেখা ভুবন। পুরো কাপ্তাই লেকের এরিয়াল ভিউ। অনেক নীচে নীল জলরাশির মধ্যে জেগে আছে ছোট ছোট বিছিন্ন সবুজ দ্বীপ। টুরিষ্ট বোটগুলোকে লাগছে খেলনা বোটের মতো। দুরে-বহু দুরে ঝাপসা নীল পাহাড়-মায়াবী হাতছানি। সামনে একটা বাজার। পাহাড়ী উপজাতীয়দের ভিড়। সবার পরনে রঙবেরঙের পোষাক। কিছু মহিলার হাতে তাজা জবা ফুল। পুজার অর্ঘ্য। কারোও হাতে প্রসাদের প্যাকেট। রাস্তার একধারে কচি সবুজ ডাব নিয়ে বসেছে কিছু উপজাতি মহিলারা। দামে বেশ সস্তা। অটো থেকে নেমে পড়লাম। উদ্দেশ্য ডাব খাওয়া নয়, সিগারেট। ডাবের পানির সাথে সিগারেটের ধোঁয়া। লেকের পানির উপর জেগে আছে মন্দিরের চূড়া। সমস্ত মন্দির পানির নীচে। চূড়ায় গাঁদা ফুলের মালা। পূজা-অর্চণা নিয়মিতই চলে। ভাবতেই কেমন যেন রোমাঞ্চ জাগে। সাথে বেদনাও। একটা আস্ত জনপদ কাপ্তাই লেকের নীচে।


এখানে কাপ্তাই লেকের ইতিহাস একটু তুলে ধরলে নিশ্চয় বাহুল্য হবে না।১৯৫৬ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার রাঙামাটি জেলায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কর্ণফুলি নদীতে জল-বিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। এই বাঁধের ফলে রাঙামাটির ৫৪,০০০ একর (২২০ বর্গকি.মি) এলাকা পানির নীচে চলে যায় এবং এই কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি হয়। লক্ষাধিক উপজাতি ও বাঙালী লোক তাদের ঘর-বাড়ি,কৃষিজমি হারায়। অনেকে অরুণাচল,মিজোরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তাছাড়া তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদ্বিপ রায়ের (বর্তমান রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশিষ রায়ের পিতা) রাজবাড়ি ১৯৬০ সালের দিকে পানির তলায় ডুবে যায়। পরে অবশ্য কাপ্তাই লেকের পানি কমে গেলে রাজবাড়িটি দৃশ্যমান হয় এবং রাঙামাটিতে পর্যটকদের প্রধান আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। চাকমাদের অতি পবিত্র এই রাজবাড়ি। অনেকে আগে গিয়েছিলাম। জুতা খুলে ঢুকতে হয়। ভিতরে একটা মিউজিয়াম। ছবিসহ চাকমা রাজাদের ইতিহাস।এইবার যাওয়ার উপায় নেই। বর্তমানে পর্যটকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়না এখানে।


বর্তমানে ফিরে আসি। অটো চলছে। প্যাঁচালো রাস্তা দিয়ে উপরে উঠছে। রাস্তা খাড়া। ইঞ্জিনের আর্তচিৎকার। ভয় লাগছে-না জানি ইঞ্চিন বিগড়ে যায়। ড্রাইভার নির্বিকার। মুখে অভয় বাণী। টুরিষ্ট স্পটের নাম ‘বেড়াইন্যা’। হাতের ডানে পড়। এখানে থামলাম না। আমাদের গন্তব্য কাপ্তাই বাঁধ। ড্রাইভার বলল, কাপ্তাই বাঁধে এখন সাধারণ টুরিষ্টদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। অসাধারণ টুরিষ্ট- যারা উপর মহল থেকে পারমিশন আনতে পারে,কেবল তারাই কাপ্তাই বাঁধ পরিদর্শণ করতে পারে। তবে বাঁধের কাছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর একটি পিকনিক স্পট আছে-ছুটির দিনে বেশ জন সমাগম হয়। ড্রাইভারকে বললাম,‘ আমায় হাত ধরে সখা নিয়ে চল, আমি যে পথও চিনি না’। বেশ কয়েকটা চেক-পোষ্ট পার হতে হলো। পিকনিক স্পট-এ নামলাম। অটো আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে একটু দুরে যেয়ে পার্ক করলো। পাহাড়ের মাথা সমান করে পিকনিক স্পটটি গড়ে উঠেছে। ছুটির দিন বলে ভিড় বেশী।বেশীর ভাগই চিটাগাং-এর লোকাল। কোলাহলে মুখর। সবাইকে মনে হলো খুশির ঠেলায় ঘোরতে এসেছে। সবুজ ঘাসে ছাওয়া স্পটটি রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিঙের পাশে দাড়ালে অনেক নীচে লেকের নীল জল চোখে পড়ে।একপাশে একটা এসি কটেজ। রাতে থাকা যায়। ইচ্ছে করলে সারাদিনের জন্য ভাড়া নেওয়া যায়। একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে টিলার শরীর কেটে নিচে চলে গেছে। নিচে সুন্দর ছোট একটা ব্রীজ দুটি টিলাকে সূংযুক্ত করেছে। লেকে বোট আছে বেশকিছু। কিছু পয়সা খরচ করলেই আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামায় আমি নেই। রেলিং-এর পাশে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে সৌন্দর্য অবলোকন করলাম। টিলাগুলো সবুজ। নীল আকাশের ছায়া পড়েছে লেকের জলে।


দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পেটে দানা পানি কিছু নেই। সৌর্ন্দয উপভোগ অপেক্ষা পেট-পূজো উত্তম। সবাইকে নিয়ে অটোতে উঠে পড়লাম। অটোতে মোটামুটি গাদাগাদি করেই বসতে হয়েছে। পিছনে আমার সহধর্মী মুনিয়া, শ্যালিকা রাহা, আমার বড় মেয়ে রোসা আর ছোট মেয়ে লিরিক। সামনে ড্রাইভারের পাশে আমি (লেখক) ও শ্যালিকার স্বামী অভি প্রায় বাদুড় ঝোলার মতো। যতবার রাস্তার বাঁক পেরিয়েছি,মনে হয়েছে এই বুঝি ছিটকে পড়লাম। রাস্তা এমন চড়াই-উতরাই আর আঁকা-বাঁকা জানলে মাইক্রো ভাড়া করতাম। পাঠকরা, আপনারা যদি এখানে কোন দিন আসেন, তাহলে প্রাইভেট কার অথবা মাইক্রো ভাড়া করে আসবেন। যাত্রা সুগম ও আরামদায়ক হবে।


মসৃণ রাস্তা । চারিদিকে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে বিশাল গাছগুলো প্রহরীর মতো দাড়িয়ে আছে। শাল-সেগুন-মেহগনি আর নাম না জানা কত গাছ। মাঝে মাঝে পায়ে চলা কাঁচা রাস্তা হারিয়ে গেছে কোন টিলার দিকে। বাতাসে বুনো প্রকৃতি ঘ্রাণ। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামলো অটো। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের। ভিতরে উঁকি দিলাম। খাবারের কথা একজনকে বলতেই বলল টোকেন নিতে হবে। সেল্ফ সার্ভিস। ঘুরতে এসে টোকেন নিয়ে সেল্প সার্ভিসে খাবার সংগ্রহ করতে হবে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। ধুর ছাই! এখানে না। অন্য কোথাও যেতে হবে। ড্রাইভারকে বললাম অন্যকোন রেস্টেুরেন্টে নিয়ে যেতে। মাইল তিনেক যাওয়ার পর আমাদেরকে এক তলা একটা রেস্টুরেন্টে নামিয়ে দিল। ঠিক রাস্তার উপরে রেস্টুরেন্টটি।একদিকে পাহাড়,অন্যদিকে লেকের পাড়। ভিতরে দেখলাম অনেকগুলো লম্বা টেবিল । প্রায় খালি। এক কোনে ক্যাশ-কাউন্টার। ওয়েটার ছুটে এল। চটপটে। মুখে অমায়িক হাসি। টেবিল পরিষ্কার করে দিল। খাবারের মেনু সাধারণ। আতপ চালের ভাত, কাচকি মাছের ফ্রাই,গরু মাংসের ভূনা ডাল আর সালাদ। খিদে লেগেছিল। সবাই তৃপ্তি করে খেলাম।খাওয়ার পর এক কাপ চা হাতে রেস্টেুরেন্টের বাইরে লনে এসে বসলাম। সামনে কাঠের রেলিং। কাপ্তাই লেক চলে গেছে দুরে দুটি টিলার মাঝখান দিয়ে। একটা টিলার উপরের কিছু অংশ পরিষ্কার করে চা চাষ করা হয়েছে। পাশে একটি বাঁশের কুটির। আকাশে পেঁজা তুলার মতো মেঘ। শিল্পী হলে হয়তো রঙ-তুলি নিয়ে বসে পড়তাম। আপাতত আমার ডি-এস-এল-আরই ভরসা। বিকেল ঘনিয়ে আসছে। সূর্যের তেজ কমে গেছে। আলো থাকতে থাকতে হোটেলে ফিরতে হবে। দিনের আলোতে পাহাড় যতই আনন্দদায়ক হোক না কেন, রাতে ঠিক ততটা আনন্দদায়ক নাও হতে পারে। অচেনা জায়গা,সাথে পরিবার-পরিজন।যেকোন বিপদ হতে পারে। আলো থাকতে থাকতে ফেরাই বুদ্ধিমানের কাজ। ড্রাইভারের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ফিরতি পথ ধরলাম। পাহাড়ে বিকেল নামছে। চারিদিকে মায়াবী আলো ছড়িয়ে একটি দিনের অবসান হচ্ছে। রাস্তা এখন ঢালু। অটো নিচে নামছে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে।


এ রাস্তায় বাস চলে না। মাঝে মাঝে দু-একটা অটো, মাইক্রো কিংবা প্রাইভেট কার আমাদেওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। দু-একজন পাহাড়ী হেঁটে চলছে। প্রচন্ড পরিশ্রমী পাহাড়ীরা। হেঁটে যেতে পারে, মাইলের পর মাইল ক্লান্তিহীন। লোকালয় এখানে দুরে দুরে। পদযুগলই একমাত্র ভরসা। সামনে ‘বেড়াইন্যা’ নামে লেক শোর ক্যাফে পড়ল। পাঠক, যাওয়ার সময় এই স্পটটিতে আমরা যাইনি। এখন ফেরার সময় এখানে একটু ঢু মারলাম।রাস্তা থেকে একটি পায়ে চলা পথ চলে গেছে লেকে দিকে। পথের দু’ধারে লম্বা শণ ঘাস। লেকের এক পাশে স্পিডবোর্ড ভাসছে বেশকিছু।পাশেই রেস্টুরেন্টে প্রবেশের পথ।লেকের পাড়ে বেশ কিছু জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে উঠেছে এই রেস্টুরেন্টটি। বড় গাছের নীচে একটি টায়ারের দোলনা। আশে পাশে ছোট ছোট বেঞ্চ। একপাশে মূল রেষ্টুরেন্ট । কাঠামো টিন ও বাঁশের। লেকের ঠিক কিনারা ঘেষে কাঠের পাটাতন। উপরে খড়ের ছাউনি। সেখানে বসে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা হাতে হাত রেখে দুনিয়াদারী ভূলে পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সফরসংগীরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। কেউ গেল টয়লেটে হাল্কা হতে আবার কেউ একটা বেঞ্চ দখল করে লেকের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইল। আমার মেয়েরা টায়ারের দোলনায় দোল খাচ্ছে আর হাসছে। গাছের নীচে একটা বেঞ্চ দখল করলাম। গাছের তির্যক ছায়া লেকের পানি ছুঁয়ে আছে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত লেকের জলরাশি দুরের পাহাড়ের সাথে মিতালী করেছে।

মনের কোনে কোথায় যেন বিচ্ছেদের সূর। ফিরতে হবে। ফিরে চললাম অটো-এর দিকে। ড্রাইভারকে বললাম তবলছড়ি থামতে। তবলছড়িতে একটা মার্কেট আছে। রাঙামাটি শহরের শেষপ্রান্তে মার্কেটটি। উপজাতীয় পণ্য সামগ্রীর অনেকেগুলো দোকান। উপজাতীয় তরুণীরাই দোকান চালায়। কেনাকাটা শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। বউ,শ্যালিকা আর মেয়েরা মনের খুশিতে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঢুকছে আর আমার মানিব্যাগ ক্রমে হালকা হচ্ছে। মাকেটিং-এ মেয়েরা বোধ হয় কখনো ক্লান্ত হয় না। হোটেলে ফিরলাম। রাঙামাটিতে আজকেই শেষ রাত। ডিনার করলাম ডিসি-বাংলোর সেই পাইরেট রেস্টুরেন্টে । মেনু গতকালকেই ঠিক করা ছিল। খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা চলল রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। আহারান্তে আবার হোটেলে ফিরলাম। এগারোটার মধ্যে বিছানায়। কালকে ফিরতে হবে ঢাকায়। সব পাখি ঘরে ফিরে-আমাদেরকেও ফিরতে হবে নিজ আলয়ে-পিছনে পড়ে থাকবে শুধু স্মৃতির খঁড়-কুঁটো।